ভূমিকা
মালূক্যপুত্ত বুদ্ধের কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে এই লোক কি অন্ত, না কি অনন্ত ? বুদ্ধ তার সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন। বুদ্ধের এই নৈঃশব্দের বহু ব্যাখ্যা আছে। তার মধ্যে একটি এরকম: লোক অন্ত না অনন্ত, এটি একটি আধিবিদ্যক প্রশ্ন। এই প্রশ্নের মীমাংসায় দুঃখের নিরসন হয় না। আর যে প্রশ্নের নিরসনে দুঃখ নিবারণ হয় না তার উত্তর দিতে বা খুঁজতে তিনি আগ্রহী নন।আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই অর্থহীন প্রশ্নে আমাদের সময় ব্যয় করতে হচ্ছে কারণ বর্তমান পৃথিবীতে প্রবৃদ্ধি (growth) নামক একটি সমস্যা উৎপন্ন হয়েছে। এবং এই সমস্যা আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
ন্যায়িক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতে হয়, লোক (এখানে পৃথিবী) যদি অন্ত (সীমিত) হয় তাহলে তার বৃদ্ধি কোনোমতেই সম্ভব নয়, কারণ তার একদিক বাড়াতে গেলে আরেক দিকে টান পড়বে। আর লোক যদি অনন্ত হয় তো বৃদ্ধির তো কোনো প্রশ্নই ওঠেনা, কারণ তা ইতিমধ্যেই অনন্ত।
এবারে আসি আধুনিক বিজ্ঞানের অভিধায়। আধুনিক বিজ্ঞান, অন্তত নিউটনীয় বিজ্ঞানের বোঝাপড়ায় পৃথিবী একটি সসীম গ্রহ। তাই যদি সত্য হয়, তবে স্বাভবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এরকম একটি সসীম গ্রহে কি অসীম প্রবৃদ্ধি সম্ভব?
কিন্তু সমস্যা হলো, আধুনিক মানবিক বিজ্ঞান, যেমন অর্থনীতি, তার বহুবিধ জটিল প্রবৃদ্ধি তত্ত্বের (Growth Theoryর) মাধ্যমে অঙ্ক কষে প্রমাণ করে দিচ্ছে যে প্রবৃদ্ধি সম্ভব। সমৃদ্ধি সম্ভব। এবং পরিসংখ্যানবিদ্যা (Statistics) নিত্য নিত্য সে সব পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দলিল মারফত। তাহলে কি বুঝতে হবে যে এইসব তত্বসমূহে আর হিসাবনিকাশে কিছু গোলমাল আছে?
সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গেলে আগে প্রবৃদ্ধির মূল ছকটা বা তার scheme of thingsটা একটু বুঝে নেওয়া দরকার।
প্রবৃদ্ধির খেলা
এখানে প্রবৃদ্ধি (growth) বলতে আমরা অবশ্যই বুঝছি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। অর্থাৎ, টাকার অঙ্কে যে প্রবৃদ্ধি মাপা যায়।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির ছক প্রকৃতপ্রস্তাবে এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিরই ছক। এই ছকে অর্থনীতির শকটটিকে দৌড় করাবার জন্য চাই একটা তাগড়া ইঞ্জিন। আর চাই সেই ইঞ্জিনকে চালানোর জন্য অফুরন্ত টাকার যোগান।
একটি দেশে সারা বছরে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবাদ্রব্য (commodity and services) উৎপন্ন হয় তাকে সে দেশের GDP বা মোট জাতীয় উৎপাদন বলে। এই উৎপাদনের পরিসংখ্যান আমরা পাই
টাকার অঙ্কে। তা সে Nominal GDP হলে বর্তমান মূল্যস্তরে, আর Real GDP হলে কোনো নির্দিষ্ট বছরের (base yearএর) মূল্যস্তরে। আর বছর বছর টাকার অংকে ওই দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির শতকরা হারকে বলে সে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার।
প্রবৃদ্ধির লজিকের সবথেকে গোলমেলে বস্তুটি হচ্ছে ওই টাকা।
প্রবৃদ্ধির হার পরিমাপের প্রশ্নে টাকা এক ধরনের একক হিসেবে কাজ করে। তারপর সেই টাকার অঙ্ককে ডলারে বদলে দেখে নেওয়া হয় দেশে কিরকম প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তারপর তাকে অন্য সব দেশের প্রবৃদ্ধির হারের সাথে মিলিয়ে দেখে নেওয়া হয় যে অন্যের তুলনায় তার কিরকম উন্নতি হচ্ছে, বা তার স্থান কোথায়। পৃথিবীর সামনে সেই রিপোর্ট প্রতিবছর বিশ্বব্যাঙ্ক পেশ করে। তারপর বিস্তারিত ছানবিন করে দেখিয়ে দেয় ওই দেশের অর্থব্যবস্থায় কোথায় কি ঘাটতি আছে। কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে তার মোকাবেলায়, ইত্যাদি।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে অর্থনীতি মানব বিজ্ঞান। তাই অর্থনীতির এই একক পদার্থবিদ্যার এককের মত কোনো নিরপেক্ষ একক হতে পারে না। ডলারের সাথে তার যে সম্পর্ক, তা প্রকৃতপ্রস্তাবে ক্ষমতার সম্পর্ক। ওদের সংজ্ঞা অনুসারে ভারতবর্ষ একটি তৃতীয়বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ মাত্র। তাই ওই একককে সবার আগে প্রশ্ন করতে হবে। এবং তা করতে হবে ভূরাজনীতির (geopoliticsএর) নিরিখে।
*
পুঁজিবাদী বাজারে টাকা এক আশ্চর্য পণ্য। সে বিমূর্তকে মূর্ত করে তোলে, আর মূর্তকে বিমূর্ত।
উধাহরন ১: এই ব্যবস্থায় বুদ্ধি করে বাজার নামক এক বিশ্বব্যাপী ভুলভুলাইয়া সৃষ্টি করা হয়েছে। ভুলভুলাইয়ার এই খেলাঘরে উৎপাদিত প্রতিটি বস্তুকে টাকা নামক পণ্য দিয়ে মাপা হয়। অর্থাৎ, তার মূল্য টাকার অঙ্কে পেশ করা হয়। সে বস্তু হতে পারে মূর্ত বা বিমূর্ত। যেমন মানুষের শ্রম বা বুদ্ধি একটি বিমূর্ত বস্তু। কিন্তু আপনার মাস মাইনে বা দৈনিক মজুরি তাকে মূর্ত করে তোলে। এর উল্টো দিকে পানীয় জল বা নিঃশ্বাসের বায়ু অতি মূর্ত বিস্তু। কিন্তু কোম্পানি তাদের বোতলে বা সিলিন্ডারে ভোরে বিমূর্ত করে তোলে। প্রকৃতির নিঃশর্ত দান বাজারের বিমূর্ত পণ্যে রূপান্তরিত হয়। এটি মূর্তায়নের একটি স্তর।
উদহারন ২: বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক যখন কোনো এক পুঁজিপতিকে ঋণ দেয়, তাকে credit creation বলে। এককথায় এই credit creationকে making money out of thin air বলা যেতে পারে। যদি সেই ঋণের পরিমাণ ১০০০ কোটি টাকা হয়, তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এই ব্যবস্থায় যেকোনো মুহূর্তে হাওয়া থেকে ১০০০ কোটি টাকার value create করা যায়। এবং তা সম্ভব হয় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের একটি জাদুকরি চুটকিতে। আবার যখন ওই পুঁজিপতি ব্যবসা করে ওই ব্যাঙ্ককে ওই টাকা ফেরত দেয় (যদি দেয়), তাহলে আবার ওই ১০০০ কোটি টাকার মূল্য হাওয়া হয়ে যায়। কিন্তু মজা হচ্ছে এই হাওয়া হাওয়া খেলার মাঝখানে ওই বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক ওই বায়বীয় টাকার ওপর সুদ উপার্জন করে, আর ওই পুঁজিপতি ওই বায়বীয় টাকা খাটিয়ে মুনাফা উপার্জন করে। এখানে ওই বায়বীয় টাকা হলো বিমূর্ত বস্তু, আর তা খাটিয়ে সুদের যে টাকা বা মুনাফার যে টাকা, সেই টাকাকে বলা যায় মূর্ত টাকা। কারণ সেই টাকা ওই ব্যাঙ্কের এবং ওই পুঁজিপতির ঘরে উঠেছে। এটি মূর্তায়নের আরএকটি স্তর।
আর এই বিমূর্ততা-মূর্ততার খেলার মধ্যে দিয়ে নিশ্চিত হয় দেশের প্রবৃদ্ধি।
তো স্বাভবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে যে, তাহলে কি স্রেফ হাওয়া থেকেই ওই সুদ আর মুনাফা উৎপন্ন হলো? হাওয়া থেকেই কি দেশের প্রবৃদ্ধি হলো? পরবর্তী পর্বে এব্যাপারে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো। আপাতত এটা বলে রাখা যে, না, এটাই সব নয়। কারণ এই প্রবৃদ্ধির অন্যতম উপাদান মানুষের শ্রম ও বুদ্ধি, এবং তার সাথে প্রকৃতির যাবতীয় নিঃশর্ত দান, তার ভূমি, জল, বায়ু, উত্তাপ, উদ্ভিদ, অরণ্য ও প্রাণিকুল।
*
টাকা এমন এক পণ্য যার পুরো মূল্যটাই মার্কসীয় ভাষায়, তার বিনিময় মূল্য (exchange value)। অর্থাৎ, প্রকৃতপ্রস্তাবে তার কোনো ব্যবহারিক মূল্য (use value) নেই। বাস্তবে সে এক টুকরো ছাপানো কাগজ মাত্র যা অন্যথায় আমাদের কোনো কাজে লাগেনা। (যেমন এই মুহূর্তে মার্কিন ডলার এমনকি সোনার দ্বারাও সমর্থিত নয়। তবু পৃথিবীর প্রতিটি দেশ তাকে reserve currencyর দরজা দেয়)। সে দাড়িয়ে আছে ওই এক টুকরো কাগজের ওপর মানুষের অসীম আস্থার জোরে। এই আস্থা একান্তভাবেই রাষ্ট্র ও পুঁজির ক্ষমতার দ্বারা উৎপাদিত আস্থা। আর ওই বাজার নামক খেলাঘর এই আস্থার সুযোগ নিয়ে, এবং তার সাথে তার ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে, ঠিক করে দেয় যে কয়লার দাম কত হবে, আর হিরের দাম কত। তার সাথে এও ঠিক করে দেয় যে খনি শ্রমিকের মজুরিই বা কত হবে, আর খনি ইঞ্জিনিয়ারের মাইনেই বা কত। কারণ সবই তো সেই মূর্ততা-বিমূর্ততার খেলা। আর এই খেলা প্রতিনিয়ত ওই ছাপানো কাগজের টুকরো মারফত সম্পন্ন হচ্ছে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই বাজারে মানুষের শ্রমের যেমন বিভাজন ও price tag আছে (একজন শিক্ষক কলেজে কয়েকটি ক্লাস করে যে টাকা রোজগার করেন, তার বাড়ির রাধুনী বা আয়া সারা মাস খেটেও সেই টাকা রোজগার করে না), সেরকম বস্তুরও বহুবিধ বিভাজন তথা price tag আছে (যেমন হীরে ও পানীয় জলের দাম এক নয়)। এদের মধ্যে কিছু বস্তুকে সম্পত্তি বা asset বলে চিহ্নিত করা হয়, যেমন share, bond, bullion, real estate, art, ইত্যাদি। এবং এই সব সম্পত্তির শুধু বাজার নয়, ফাটকাবাজারও (speculative marketও) আছে। অর্থাৎ, একজন পুঁজিপতি যখন তার কোম্পানিতে টাকা খাটিয়ে মুনাফা করতে পারেন বলে বাজারে খবর হয়, তখন ফাটকায় তার কোম্পানির শেয়ার মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে।
এখন বোঝাই যাচ্ছে যে এই প্রবৃদ্ধির খেলায় পুঁজিপতি লালে লাল। প্রথমত, বায়বীয় টাকা খাটিয়ে মুনাফা (profit), দ্বিতীয়ত, ফাটকা থেকে মুনাফা (capital appreciation)। ফাটাকার সে মুনাফা তো পুরোটাই বায়বীয় ব্যাপার। কিন্তু এই খেলার ফলে সাধারণ মানুষ আর পৃথিবীর কি দশা হলো সেটাই আপাতত দেখার বিষয়।
প্রবৃদ্ধির জমাখরচ
যদি ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের আগমনকালকে প্রবৃদ্ধির এই খেলার starting point হিসাবে মনে নিই, তাহলে নিশ্চিন্তে বলা যেতে পারে যে পৃথিবীর বুকে এই প্রবৃদ্ধির খেলা প্রায় একটানা আড়াইশো বছর ধরে চলছে। এই খেলার সব থেকে বড় শিকার মানুষ ও পৃথিবী।
অর্থনীতির এই যন্ত্র মানুষের শ্রম তথা সৃজনশীলতাকে নিংড়ে নেয়। শ্রম সে আগেও করতো। আগেও উৎপাদন করতো। তখন সেই উৎপাদন ছিল তার শ্রম ও সৃজনশীলতার অভিব্যক্তি। সেসময়ে গ্রামের কোনো একজন তাঁতী, তার হস্তচালিত তাঁতে কোনো একটা শাড়ি বানিয়ে বিক্রি করে দেওয়ার পরেও, কোনো এক যুবতীকে দেখিয়ে, একথা নির্দ্বিধায় গর্বের সাথে বলতে পারতো যে, ওই যে ওই যুবতী, যে ওই সুন্দর শাড়িটি পড়ে আছে, ওটা আসলে তারই শাড়ি। একথা সে বলতে পারত কারণ তখনো পর্যন্ত তার সাথে তার শ্রমের ফসলের বিচ্ছিন্নতা (estrangement) ঘটেনি। কিন্তু রিলায়েন্স কোম্পানির শ্রমিক এটা বলতে পারবে না। কারণ সেখানে সে তার দৈনিক শ্রম টাকার বিনিময়ে বিক্রি করছে মাত্র। এখানে তার শ্রমের সম্পর্ক টাকার সাথে, শ্রমের ফসলের সাথে নয়। তাই সেই শ্রম কি বস্তু উৎপাদন করছে (রাসায়নিক সার না পারমাণবিক বোমা), বা সেই উৎপাদিত বস্তু কে কিনছে (গরিব চাষি না সামরিক দপ্তর), বা সেই বস্তু মানুষের বা পৃথিবীর কি উপকারে বা অপকারে লাগছে, এসব নিয়ে তার মাথা না ঘামালেও চলে। মানুষের সাথে মানুষের শ্রম তথা সৃজনশীলতার এই বিচ্ছিন্নতাকেই মার্কস Alienation বলেছেন। মানুষের জীবনে এর থেকে বড় রিক্ততা আর কিছু হতে পারে না।
গায়ত্রী স্পিভাক খুব ভালো বলেছেন। আসলে ভাববাদীদের চেতনা আর বস্তুবাদীদের শ্রম একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। সব কিছুই subjectএর predicationএর ওপর নির্ভর করে। মোদ্দা কথা, আধুনিক মানুষ যে শ্রমগতভাবে এবং/অথবা চেতনাগতভাবে এই বিচ্ছিন্নতার শিকার তা তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই। এই বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়েই তো এহেন অর্থব্যবস্থা কাউকে দিয়ে টাকার বদলে খনি থেকে কয়লা তোলায়, আর কাউকে দিয়ে তোলায় নদী থেকে বালি। কাউকে দিয়ে টাকার বদলে অর্থনীতির মাস্টারি করায়, আর কাউকে দিয়ে আঁকায় রঙবেরঙের ছবি। মনের সাথে যেন টাকা ছাড়া আর কিছুর সম্পর্ক নেই। যেন টাকা পাওয়ার পর তার আর কোনো দায় নেই, আর কোনো দায়িত্ব নেই তাদের।
এখন এই estranged, alienated মানুষজন তাদের শ্রম তথা সৃজনশীলতা বেচা অর্থ নিয়ে বাজারে যায় জিনিসপত্র কিনতে। সেখানে গিয়ে তাদের মাথা ঘুরে যায়। রাশিরাশি স্তূপীকৃত চোখধাঁধানো পণ্যের সমাহার দেখে তারা আর বুঝতে পারে যে ওগুলো আসলে তাদের শ্রমেরই ফসল। বা বলা ভালো ওগুলো তাদের সাথে এই পৃথিবীর সৃজনশীল মিথষ্ক্রিয়ার ফসল। তাদের মনে হতে থাকে যে উৎপাদন ও বিনিময় যেন পণ্য ও অর্থের মধ্যেকার সামাজিক সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের কোনোখানে কোথাও যেন তারা নেই। মানুষ নেই, প্রকৃতি নেই। মার্কস একেই পুঁজিবাদী অর্থনীতির পণ্য রিরংসা বা commodity fetishism বলেছেন।
*
আচ্ছা, এরকম একদল estranged, alienated মানুষের হাতে যদি বুদ্ধি করে টাকার যোগান খানিকটা বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে কি হতে পারে? বিশেষত, সারাদিনের মনহীন শ্রম নিংড়ানির শেষে, একরাশ শুন্যতা নিয়ে সে যখন ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরে। যখন তার হু হু করা মন কিছু একটা অবলম্বন খোঁজে। তখন রাস্তার বাঁকে বা চৌমাথায় যদি নিয়ন আলোর বিচ্ছুরণ আর চকমকে গ্লোসাইন বোর্ড তাকে পুলকিত করে, তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকে কি? তারপর বাড়ি ফিরে টেলিভিশনের পর্দায় রাশি রাশি বিজ্ঞাপন তার ক্ষুধা আরো বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। তার সাথে আছে খবরের কাগজ থেকে মুঠোফোন, সবকিছুতেই বিজ্ঞাপন, সব জায়গাতেই ভোগের (consumptionএর) হাতছানি। সেই রিক্ত, নিঃস্ব মানুষ তখন নিশির সেই ডাক উপেক্ষা করতে পারে কি? পারে না, কারণ এই সর্বব্যাপী শূন্যতার মধ্যে সে বেঁচে থাকার আর কোনো অবলম্বন খুঁজে পায় না। তার যা ছিল তা সবই তো সে বেচে দিয়ে এসেছে। এখন কেনার পালা। সে কেনে। শুধু কেনে। আরো আরো কেনে। আর সে যত কেনে, তার কেনার ক্ষুধা তার তত বেড়ে চলে। এভাবে ক্রমে সে তলিয়ে যেতে থাকে এই consumerist cultureএর চোরাবালিতে।
মানুষ যত কেনে উৎপাদন তত বৃদ্ধি পায়। দেশের GDP তত বাড়ে। দেশের অর্থনীতিতে সেই হারে প্রবৃদ্ধি হয়।
আর ব্যক্তি মানুষ শুধু কেনে এমন নয়, ব্যক্তি মানুষ যা কেনে তাকে বলে ভোগ্য পণ্য ও সেবাদ্রব্য (consumer goods and services)। তার সাথে আছে বিপুল পরিমাণ মূলধন পণ্য (capital goods)। যেমন কলকারখানা, মেশিনপত্র। জাহাজ থেকে উড়োজাহাজ হয়ে বিভিন্ন ধরনের ছোট ও বড় যানবাহন। রাস্তাঘাট। নগর থেকে বন্দর। লম্বা লম্বা সেতু থেকে বড় বড় বাঁধ, যাকে বলে পরিকাঠামো। এগুলো সবই কিন্তু একেক ধরনের মূলধন পণ্য। তার সাথে আছে আরো এক বিশেষ ধরনের মূলধন পণ্য, যাকে প্রতিরক্ষা পণ্য বলে, যার পরিমাণও বিপুল। এসব পণ্যের ক্রেতা হলো রাষ্ট্র ও করপোরেশন সহ দেশের বিভিন্ন বড় ও ছোট মাপের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
এইযে এই প্রতিটি পণ্য, সে ভোগ্য পণ্য হোক বা মূলধন পণ্য, তা উৎপাদন করতে মানুষের শ্রম বা সৃজশীলতা ছাড়া আর যা লাগে, অর্থনীতির ভাষায় তাকে কাঁচামাল বা প্রাকৃতিক সম্পদ বলে। কিন্তু আমরা জানি আসলে তা হলো এই পৃথিবীর নিঃশর্ত দান, তার অপরিমেয় ঐশ্বর্য। সেই ঐশ্বর্য, সেই নিঃশর্ত দান পণ্য উৎপাদনের নামে, প্রগতির নামে, উন্নয়নের নামে, প্রবৃদ্ধির নামে নির্বিচারে লুঠ করা হয়। প্রবৃদ্ধির নামে লুঠ করা হচ্ছে গত আড়াইশো বছর ধরে (যদি শিল্প বিপ্লবের সময়কাল থেকে আমরা ধরি)।
*
এবারে, এই বিধ্বংসী পণ্য সংস্কৃতির হিসাবের খাতাটা নিয়ে একটু বসা যাক। প্রতিটি লাভলোকসানের অঙ্কের দুটো দিক থাকে। একটা তার আয়ের দিক, আর একটা ব্যয়ের। অর্থনীতির হিসেবও যদি মানি, তবে আয়ের থেকে ব্যয় বাদ না দিলে কি করে বুঝবো যে আমরা লাভে আছি না লোকসানে।
একটি দেশের, কোনো একটি বছরের আয় তথা উৎপাদনের হিসেবনিকেশকে সে দেশের National Income Accounting বলে। তো দেখা যাচ্ছে যে সেই হিসেবের খাতায় শুধু আয়ের দিকটি বা উৎপাদনের দিকটি দেখানো আছে। অর্থাৎ, সে হিসেবের খাতায় শুধুমাত্র দেখানো হয়েছে যে, ওই বিশেষ বছরে ওই দেশে কি পরিমান পণ্য ও সেবা উৎপন্ন হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, ব্যয়ের ঘরে কিছু দেখানো নেই।
এখন আমরা যদি এই ব্যয়ের হিসেব কষতে বসি তো বেরোবে যে জাতীয় আয়ের নামে, জাতীয় উৎপাদনের নামে, প্রগতির নামে, উন্নয়নের নামে, প্রবৃদ্ধির নামে কি পরিমান অরণ্যকে ধ্বংস করা হয়েছে। কতগুলো নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে। মাটির নিচে থেকে কি পরিমান জল তুলে নেওয়া হয়েছে। কালো ধোঁয়া ছেড়ে বাতাসকে কি পরিমানে কলুষিত করা হয়েছে।
না, টাকার অঙ্কে এ হিসেব সম্ভব নয়। কারণ এই পৃথিবীর নিঃশর্ত দান, তার অপরিমেয় ঐশ্বর্যকে যারা টাকার অঙ্কে মাপে আমাদের লড়াই তাদের বিরুদ্ধে। শুধু বলার যে, ওই প্রবৃদ্ধির হিসেবটায় গন্ডগোল আছে, কারচুপি আছে।