সম্প্রতি “ইয়েল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ল’ অ্যান্ড পলিসি”র রিপোর্ট গত বছর এগারোটি বিষয়ে চল্লিশটি সূচক ব্যবহার করে একশ’ আশিটি দেশের একটি সূচক প্রকাশ করেছে। ভারত এই তালিকায় সবার শেষে আছে। ভারত সরকারও শোনামাত্রই সূচকে নীচের স্থান প্রত্যাখ্যান করেছে, “অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি”র কারণে। তবে গত বছর যখন ভারতকে এই একই তালিকায় একশ’ আটষট্টিতম স্থান দেওয়া হয়েছিল, তখন আমরা কিছু বলিনি। কারণ আমাদের লজ্জা থেকে সেই বছর বাঁচিয়েছিল বুরুন্ডি, হাইতি, চাদ, সলোমান দ্বীপপুঞ্জ, মাদাগাস্কার, গিনি, কোট ডি ‘ভোর, সিয়েরা লিওন, আফগানিস্তান, মায়ানমার এবং লাইবেরিয়া। “আমরা”, অর্থাৎ কি সরকার ? না। নিজের কথাও বলছি। সব দায় সরকারের ওপর না চাপিয়ে বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে একটা প্রশ্ন মনে আসে, আমরা কি সঠিক পথে চলছি ?
এর উত্তরও সম্ভবত, না। এত পরিবেশকর্মী, এত সংগঠন, এত মেধাবী এবং এত পরিশ্রমী মানুষজন ঠিক পথে হাঁটলে আমাদের সম্ভবত এই লজ্জার তালিকা দেখতে হত না। আমরা কি জানি মিজোরামে বা ছত্তিশগড়ে কতজন পরিবেশকর্মী আছেন বা তাঁরা কী কাজ করছেন? না জানতেই পারি, তবে জানার পথে আমাদের অহমিকা বা নার্সিসিজম অন্তরায় হচ্ছে না তো? যাঁরা সক্রিয় পরিবেশকর্মী, তাঁদের অনেকে এগারো বছরে ভুলে যাইনি তো তপন দত্ত খুনের ঘটনা! তবে তপন দত্ত একা নন। কয়েক মাস আগে গ্লোবাল উইটনেসের প্রতিবেদনে দেখছিলাম, গত বছর দুনিয়া জুড়ে পরিবেশ ও জমির অধিকার রক্ষায় কাজ করা রেকর্ডসংখ্যক কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দু’হজার কুড়ি সালে বিশ্বজুড়ে দু’শো সাতাশ জনের প্রাণ গেছে, যা পরপর দু’বছরে রেকর্ড ভাঙল। এ এক অদ্ভুত ভাঙনকালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। রেকর্ড ভাঙছে, মন ভাঙছে, হিমবাহ ভাঙছে, পাহাড় ভাঙছে, নদী পাড় ভাঙছে, ভাঙছে পরিবেশও।
গ্লোবাল উইটনেস উনিশশো তিরানব্বই সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে। প্রথম থেকেই প্রাকৃতিক সম্পদ, সংঘাত এবং দুর্নীতির মধ্যে সংযোগটি এরা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য তেল, গ্যাস, খনি এবং কাঠের ব্যবসায় মুনাফা অর্জনের জন্য পরিবেশগত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তদন্তও করেছে।
তারা বলছে, ওই হত্যাকান্ডগুলির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই জড়িত সম্পদ শোষণের সঙ্গে। এমনকি বৃহৎ কৃষি ব্যবসা, জলবিদ্যুৎ বাঁধ এবং অন্যান্য পরিকাঠামো নির্মাণকার্যের বিরুদ্ধতার জন্যও পরিবেশকর্মীদের প্রাণ দিতে হয়েছে। দু’হাজার পনেরো সালে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, প্রতি সপ্তাহে গড়ে চারজন কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।
লাতিন অ্যামেরিকা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা। তাই, ব্রাজিল, নিকারাগুয়া, পেরু এবং ফিলিপাইনে হামলা সহ তেইশটি মামলায় কিন্তু খুনের সঙ্গে যুক্ত শিল্প ছিল কাঠের ব্যবসা। কলম্বিয়ায় সবচেয়ে হামলা হয়েছে, যেখানে গত বছর পঁয়ষট্টি জন নিহত হয়েছে।
গ্লোবাল উইটনেস বলেছে যে, পরিবেশকর্মীরা ক্রমাগত হুমকির মধ্যে থাকছেন। হন্ডুরাসের গুয়াপিনল নদীতীরের সম্প্রদায়গুলিকে তারা অন্তর্ভুক্ত করেছে। সেখানে মানুষজন একটি সুরক্ষিত এলাকায় কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রদত্ত আয়রন অক্সাইড খনিকে লাইসেন্স দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। প্রচারকারীরা বলছেন গুয়াপিনল নদী তাঁদের জন্য অত্যাবশ্যক। কারণ এটি পানীয় জলের একমাত্র উৎস বলছেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা হুমকির সম্মুখীন।
সম্প্রতি একই ঘটনা দেখা গিয়েছিল হন্ডুরাসের আদিবাসী পরিবেশকর্মী শ্রীমতী বার্তা ক্যাসেরেসের ক্ষেত্রে। গুয়ালকার্ক নদীতে আন্তর্জাতিক অনুদানে চলা একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করার দীর্ঘ আন্দোলন, তাঁকে হত্যা করে থামানো হয়। দু’হাজার সাল থেকে ‘সিনোহাইড্রো’ (বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের একটি বিভাগ) এবং হন্ডুরাসের কোম্পানি ‘দেসারোলোস এনার্জেটিকো’ চারটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। দু’হাজার বারো সালে নির্মাণ শুরু হয় এবং দু’হাজার তেরো সালে নদী বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্থানীয় মানুষজন প্রতিবাদ করতে শুরু করে ও নির্যাতনের সম্মুখীন হয়।
বাঁধের অফিসে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সময় প্রথম টমাস গার্সিয়া নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। বার্তা ক্যাসেরেস ছিলেন পরিবেশ রক্ষাকারী হিসেবে গোল্ডম্যান পুরস্কার বিজয়ী। তাঁকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। বার্তার মৃত্যু-বিতর্কজনিত কারণে প্রকল্পে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলি স্থগিত করে এবং তহবিল প্রত্যাহার করে।
দু’হাজার আঠার সালের শেষে আদালত রায় দেয় ও তাঁকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সাতজনকে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন মেক্সিকান পরিবেশবাদী গুস্তাভো কাস্ত্রো। ক্যাসেরেসের পরিবার এবং সমর্থকরা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে স্বাগত জানিয়েছে, তবে আদালতের বাইরে তারা এই চক্রান্তের মূলচক্রী এবং অর্থদাতাঁদের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছে।
এই তথ্যচিত্র নির্মাণের পর অবশ্য এ বছরের প্রথমে অনেক লড়াইয়ের পর দুর্দান্ত জয় পেয়েছেন বামপন্থীরা। বর্তমানে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বামপন্থী জননেত্রী জিয়োমারা কাস্ত্রো। আগে ওয়াশিংটনের রোষের মুখে পড়ে, ওবামা’র ষড়যন্ত্রে সেনা অভ্যুত্থানে এক যুগ আগে অপসারিত হন উগো শাভেজ ঘনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি ও জিয়োমারার স্বামী মানুয়েল জেলায়া। এরপরে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ থেকেই জন্ম নেয় ‘লিবরে পার্টি’। প্রতিরোধের মুখ ও নেত্রী হিসেবে উঠে আসনে জিয়োমারা কাস্ত্রো। আশা করা যায় হন্ডুরাসের বারো বছরের রক্ষণশীল, উগ্র, দক্ষিণপন্থী, মাদক কারবারি জমানার অবসান হবে এবার।
তবে এই শতকে এসেও আফ্রিকাও মৃত্যু মিছিল অব্যাহত। হত্যা হয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার শ্রীমতী ফিকাইল এনতশানগেস। ফিকাইল কোয়াজুলু-নাটাল প্রদেশের সোমখেলের কাছে টেন্ডেল কয়লা দ্বারা পরিচালিত একটি উন্মুক্ত খনির সম্প্রসারণ নিয়ে আইনি লড়াই লড়ছিলেন। তাঁকে বসার ঘরেই গুলি করে হত্যা করা হয়। পেটমিন লিমিটেড বলে একটি দক্ষিণ আফ্রিকার বানিজ্যিক সংস্থার নাম এই সূত্রে সামনে এসেছে।
ফিকাইলের মেয়ে, মালুঙ্গেলো ছাকাজা বলেছেন তার “মায়ের সংগ্রাম থামেনি। আজ পর্যন্ত আমার মা’কে হত্যার তদন্তে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আমার মনে হচ্ছে কেউ এই খনি সম্প্রসারণ এবং উত্তোলন এগিয়ে যেতে চায়, খরচ যাই হোক না কেন।”
অন্য হত্যাকাণ্ডগুলির মধ্যে অস্কার আইরাউড অ্যাডামসের মৃত্যুর ঘটনাও আছে। তাঁকে মেক্সিকোতে দু’হাজার কুড়ি সালের সেপ্টেম্বরে খুন করা হয়। তিনি সেখানে আদিবাসী কুমিয়াই সম্প্রদায়কে বিশুদ্ধ জল সরবরাহের জন্য কাজ করছিলেন।
আবার ফিরি তপন দত্ত খুনের ঘটনায়। আমরা জানি, সম্প্রতি বালির এক রাজনৈতিক দলের কর্মী তপন দত্ত খুনের ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। জলাজমি ভরাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন তপন দত্ত। সিআইডির দীর্ঘ এগারো বছরের দীর্ঘসূত্রীতা দেখে তদন্তের সমস্ত নথি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন বিচারপতি রাজশেখর মান্থার। কলকাতা হাইকোর্ট এই মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিলেও মনে কিছু প্রশ্ন আসে,
১) এত পরিবেশকর্মী ও সংগঠন স্বত্ত্বেও মামলার রায়ে দেখছিলাম লেখা “Pratima Dutta Vs. The state of WB & Ors”। কেমন হত ওঁর স্ত্রীর জায়গায় একটি পরিবেশ সংগঠন রাষ্টকে এই প্রত্যুত্তর দিত?
২) এরপর কী?
৩) সিবিআই আগামী এগারো বছরেও তাদের তদন্ত শেষ করতে পারবে বলে আমরা কি বিশ্বাস করি?
৪) বিশ্বজুড়ে ক্রমাগত হুমকি ও জীবনহানির মধ্যে দিয়ে যাওয়া মানবাধিকার ও পরিবেশকর্মীদের জন্য একজোট হওয়া ছাড়া আর কি অন্য কোন পথ আছে?
৫) প্রথমে যে কথা বলছিলাম শেষ প্রশ্নে আবার সেখানে ফিরে আসি। এগারো বছরে অনেকটা সময়, তপন দত্ত খুনের ঘটনা যাঁরা মনে রেখে সুবিচারের আশা রেখেছেন তাঁরা নমস্য। এত অকারণে খুন দেখতে দেখতে মনে না রাখতে পারা অস্বাভাবিক নয়, ভুলও নয়। ভুল হবে এই ঘটনা থেকে শিক্ষা না নিলে। “ইয়েল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ল’ অ্যান্ড পলিসি”র তালিকায় আমাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ এমন নয় তো, যে এই ঘটনাগুলি থেকে আমরা শিখছি না বা পর্যালোচনা করছি না ?
আরও পড়ুন – প্রশাসন, আধাত্ম্যচিন্তা ও জলঙ্গীর নাভিশ্বাস