বৈদ্যুতিক গাড়ি – লাল রং দিয়ে মানুষের সবুজ ভবিষ্যৎ আঁকার চেষ্টা

মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী, সে জানত একদিন বিদ্যুৎ ব্যবহার করে গাড়ি চালানো যাবে। অবশেষে দু’শো বছরের চেষ্টায় বিদ্যুৎ দিয়ে গাড়ি চালানোর প্রযুক্তি, আজ প্রায় তার আয়ত্তে। বিশ্বজুড়ে হৈ-হৈ রব, স্বাভাবিকভাবেই বৈদ্যুতিক গাড়ি র (EV) দিকে ভারতও নজর দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গেই একাধিক রাজ্য সরকারও ইভি নির্মাণে গাড়ি নির্মাতাদের উৎসাহও দিচ্ছে। নানা গুণমানের সংস্থা আজ বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণের মঞ্চে। দেশীয় কোম্পানিগুলিও (Tata Motors এবং Mahindra) ভিড় জমার আগেই নিজেদের পণ্য সাজিয়ে বসেছে৷ ইভি বায়ুদূষণ কম করে, কিলোমিটার প্রতি কমপক্ষে পাঁচ টাকা সাশ্রয়, প্রচলিত গাড়িগুলির তুলনায়! তাই সাধারণ মানুষেরও উৎসাহী। পরিবেশকর্মীদের আবার এর বিরুদ্ধে সবথেকে অকাট্য যুক্তি হল, এই প্রযুক্তি কীভাবে পরিবেশ-বান্ধব? উৎসই যেখানে কয়লা পোড়ানো, নদী হত্যা বা পারমানবিক শক্তি!

এই প্রবন্ধে বৈদ্যুতিক গাড়ি ও তার ব্যবসার বিকাশকে শুধু পরিবেশের দৃষ্টিকোণ থেকেই না দেখে মধ্যবিত্তের আয়-ব্যয়ের মাপকাঠিতে, প্রযুক্তি, উৎপাদন এবং রাজনৈতিকভাবেও দেখার চেষ্টা করব।

বাজার সরকারের তুলাযন্ত্রে বৈদ্যুতিক যানের খরচপাতি (EV)

আসি খরচের হিসাবে। আজ ভারতের জনপ্রিয়তম চার-চাকার বৈদ্যুতিক যানটির দাম একই গুণমানের পেট্রল-চালিত যানের তুলনায় প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা বেশি। ব্যাটারিগুলির আয়ুষ্কাল আট/দশ বছর বা দেড় লক্ষ কিলোমিটার। দশ বছর গ্যারান্টি ইউরোপে দেওয়া হলেও আমাদের দেশের বর্তমান প্রযুক্তিতে তা আশা করা অনুচিত। তবে কিলোমিটার পিছু খরচ কম। আন্তর্জাতিক মান কিলোমিটার পিছু সাড়ে সাত টাকা কম হলেও, ভারতের গাড়ি কোম্পানিগুলি বলছে পাঁচ টাকা। একটি পাটিগণিতের অংক কষে বিষয়টির নিষ্পত্তি হোক।

মনে করি –

১) বিদ্যুৎবাবু এক মধ্যবিত্ত, যিনি চোদ্দ লাখ টাকা দিয়ে জনপ্রিয়তম ইভিটি কিনেছেন

২) বন্ধুর বায়ুদূষণকারী পেট্রল গাড়ির থেকে পাঁচ লাখ বেশি খরচ করেও, পরিবেশবান্ধব বলে লোনেই গাড়িটি নৈমিত্তিক ব্যবহারের জন্য কিনলেন

৩) কর্মস্থল তাঁর বাড়ি থেকে দশ কিলোমিটার দূরে এবং

৪) সব ছুটি এবং গাড়ির সারানো বাদ দিয়ে তিনি বছরে দু’শো নব্বই দিন অফিস যাবেন

তাহলে ৫ টাকা/কিলোমিটার হারে আট বছরে তিনি সাশ্রয় করছেন – (৮ বছর x ২৯০ দিন x ২০ কি.মি. x ৫ টাকা/কি.মি.) = ২,৩২,০০০ টাকা।

তাহলে পাঁচ লক্ষ টাকা বেশি দিয়ে, আগামী আট বছরে তিনি সাশ্রয় করলেন ২.৩২ লাখ এবং ফিরল না ২.৬৮ লাখ। এবার আগামী আট বছর পরে যদি প্রযুক্তি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য ও সস্তা না হয় তাহলে বিদ্যুৎবাবু গাড়ির নিরাপত্তার সঙ্গে আপোস না করে নতুন ব্যাটারি কিনতে বাধ্য হবেন। যার দাম বর্তমানের হিসেবে সাড়ে পাঁচ বা ছয় লক্ষ। তাহলে আট বছরের মাথায় বন্ধুর তুলনায় বিদ্যুৎবাবু অন্য সমস্ত খরচ(ব্যাংকের সুদ, যন্ত্রাংশ) বাদ দিয়েও আট লক্ষ বেশি খরচ করবেন। নতুবা ব্যাটারির আয়ুষ্কাল পেরোন গাড়িটি জলের দরে বেচতে বাধ্য হবেন।

ইভির বিকাশ ও ভারতের প্রযুক্তিগত সমস্যা

নিকেল, লিথিয়াম এবং কোবাল্ট এই তিনটি আকরিক ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারি উৎপাদনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। এগুলির জোগান সীমিত, এবং আমাদের দেশ এ ব্যাপারে তেল বা গ্যাসের চেয়েও অসহায়। ভারতীয় ইভি’র প্রযুক্তিগত সমস্যাও রয়েছে। ইভি বাইকগুলিতে ব্যাটারি আগুনের ঘটনা গাড়িগুলির মান নিয়ে অজস্র প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রযুক্তিটি এখনও বহুলাংশেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তরে আছে।

মানের প্রশ্নে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ব্যাটারিগুলির চার্জ ধরে রাখার ক্ষমতা, যা এখনও অবধি খুব আশাপ্রদ নয়। ইলেকট্রিক গাড়ির মালিকেরাই কিন্তু গাড়িগুলি নিয়ে একশ’ কিলোমিটার পেরিয়ে যাওয়ার সাহস পান না।

ইতিমধ্যেই ভারত ইভি সংক্রান্ত এলোমেলো নীতি এবং পরিকল্পনার সমস্যায় ভুগছে। সঠিক মানের মূল্যায়নের অভাবন তো আছেই এবং আয়ুষ্কাল শেষে EV-গুলির পুনর্ব্যবহার  পরিকল্পনার অভাব সুস্পষ্ট। “Made in India” ইভির বেশিরভাগই অ্যাসেম্বল করা এবং চীন থেকে প্রায় সবকিছুই আমদানি করা।

ব্যাটারিগুলি ওজনে চার/পাঁচ কুইন্টাল। আয়ুষ্কাল শেষে কিছু মৌল (লিথিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কোবাল্ট, তামা এবং নিকেল) আলাদা করে নেওয়া হয়। মৌলগুলি ক্ষতিকারক, স্বাভাবিকভাবেই এই প্রযুক্তি সস্তা তো নয়ই বরং বেশ খরচসাপেক্ষ। তাই উন্নত দেশগুলিতেই এখনও এই রিসাক্লিং কারখানা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এই রিসাইক্লিং সঠিক পদ্ধতির মাধ্যমে না হলে কিন্তু বিষাক্ত ব্যাটারিগুলি পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। যে ক্ষতি টন টন মোবাইলের ব্যাটারি যত্রতত্র করে চলেছে।

এবার তাই প্রশ্ন আসবে- আয়ুষ্কাল শেষের ইভি গুলির কি হবে এবং পুনর্ব্যবহার আদৌ সম্ভব কিনা। যে ভয় সবাই পাচ্ছেন তা হল, বছর আট/দশেক পর এত ইভি গাড়ির হাজার হাজার টন ব্যাটারি-বর্জ্যের কী হবে! আয়ুষ্কাল শেষে এই ব্যাটারিগুলি থেকে জ্বালানি তেল দিয়ে চলা গাড়িগুলির থেকে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড বেরোলে!

সম্ভবত সঠিক রিসাইক্লিং নীতি এবং তার রূপায়ন ভবিষ্যতে ভারতকে এ সমস্যা থেকে, এবং বিদেশ থেকে কাঁচামালের উপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করতে পারে। আপাতত এ প্রযুক্তি মহার্ঘ্যই থাকবে।

লিথিয়াম, তুমি কোথা হইতে ইভিতে আসিয়াছ ?

লিথিয়াম  লিথিয়াম
লিথিয়াম

লিথিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কোবাল্ট, তামা এবং নিকেল ইভির ব্যাটারির মূল উপকরণ। লিথিয়াম/কোবাল্ট দুর্লভ বলে চীন এবং আমেরিকা বিশ্বের লিথিয়াম এবং কোবাল্ট খনিগুলির দিকে শ্যেনদৃষ্টি হেনেছে। খনিজ সম্পদে উর্বর দেশগুলিতে প্রচুর অর্থও ব্যয় করছে। ভারত এই বিষয়ে বেশ পিছিয়ে। কয়েক বছর আগে যখন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল, ভারত অংশগ্রহণ করতে দেরি করেছিল৷ ভারত সরকারের মালিকানাধীন খনিজ বিদেশ ইন্ডিয়া লিমিটেড লিথিয়াম সরবরাহের জন্য অস্ট্রেলিয়া, চিলি, বলিভিয়া এবং আর্জেন্টিনার সরকারের সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে কাজ করছে। আগে জিন্দাল স্টিল বলিভিয়াতে যুক্ত ছিল, তবে ইভো মোরালেসের জমানা থেকে আর নেই।

অস্ট্রেলিয়া লিথিয়ামের সর্ববৃহৎ উৎপাদক, তবে তাদের মজুত কম। লিথিয়ামের বিশ্ব-ভান্ডার দিয়ে আগামী একশ’ আশি বছর প্রায় ব্যাটারি উৎপাদন করা যাবে। লিথিয়াম ত্রিভুজ হল চিলি, বলিভিয়া এবং আর্জেন্টিনা – দক্ষিণ আমেরিকার এই তিন দেশ। বিশ্বের বৃহত্তম লিথিয়ামের ভান্ডার এখানেই মজুত। এর মধ্যে বলিভিয়া একাই এক তৃতীয়াংশের মালিক, তাত্ত্বিকরা বলেন বলিভিয়া একদিন আরব দুনিয়ার মতন ধনাঢ্য হবে। বাস্তবে বলিভিয়া, তাদের লিথিয়াম নিয়ে বিশ্বের কাড়াকাড়ির ফল ভুগছে। বৈদ্যুতিক গাড়ি র সর্ববৃহৎ শক্তি Tesla-কে লিথিয়াম না দেওয়ায় গদিচ্যুত হয়েছেন বলিভিয়ার প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি তথা সমাজতান্ত্রিক নেতা ইভো মোরালেস।

বৈদ্যুতিক যানে কোবাল্টের রং লাল

লিথিয়াম  কোবাল্ট
কোবাল্ট

লিথিয়ামের পর কোবাল্টের কথাও অনিবার্য। কঙ্গো পৃথিবীর প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ কোবাল্ট ভান্ডারের মালিক। ইভি’র ক্ষেত্রে চারচাকার ব্যাটারিতে, প্রায় তেরো কেজি কোবাল্টই লাগে। কঙ্গো বিশ্বের মোট উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সরবরাহ করে।

কোবাল্ট উত্তোলন-পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে নিন্দিত। টেসলার সিইও ইলন মাস্ক বলেছিলেন, এই বছরে টেসলা এই খনিজের ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়েছে । টেসলার কোবাল্টের ব্যবহার শীঘ্রই শূন্যে চলে যাবে (কবে তা অস্পষ্টই)। বছর দুয়েক আগেই সবে TESLA ইভি ব্যাটারির জন্য Glencore নামক সুইস কোম্পানির থেকে বছরে ষাট হাজার টন কোবাল্ট কেনার বিতর্কিত চুক্তি করেছে। কিছু কোম্পানি (যেমন টেসলা বা জেনারেল মোটরস) গুডউইলের জন্য নতুন রাসায়নিক সমাধান চায়। চায় কম কোবাল্ট বা অন্য ধাতুর ব্যবহার। কোবাল্ট নির্মূল করে ব্যাটারির জন্য অন্য ধাতুকে যদিও সেই পৃথিবী থেকেই খনন করতে হবে। এমন কোন ভরসাও নেই যে একদিন ব্যাটারির ভিতরের ধাতুগুলি কোবাল্টের চেয়ে উন্নত পদ্ধতিতে উত্তোলন করা হবে।

অন্যদিকে “কঙ্গোর কোবাল্ট নেব না” এমন অবস্থানও সে দেশের শ্রমিকদের এবং অর্থনীতির জন্যই আরও বেশি ক্ষতিকারক হবে। বরং এই খনিজের উত্তোলন ক্রমবর্ধমান হলে, তা কঙ্গোর শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করেই হোক! আগামী দুই দশকে কোবাল্টের চাহিদা কুড়ি গুণ বৃদ্ধি পাবে, তার সুফল শ্রমিকদেরও প্রাপ্য। কিন্তু পাচ্ছে কী?

কোবাল্ট-শ্রমিকরা সকাল সাতটায় কাজে যায় এবং সন্ধে ছ’টা অবধি কাজ করে। কাজটি শারীরিকভাবে কঠিন, তারা নিম্ন মানসম্পন্ন পরিমাণে কম খাবারকে নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে। দিনে মাত্র সোয়া লিটার জল তারা পায়, যা দুপুরে প্রচণ্ড গরম হয়ে যায়। অনেক অনুরোধেও জলের বরাদ্দ বাড়েনি। বছরের পর বছর মানবাধিকার কর্মীরা বলে চলেছেন সেখানে কাজের পরিবেশ অত্যন্ত বিপজ্জনক। শিশু শ্রমের বহুল ব্যবহার সম্পর্কেও সতর্কতা জারি করে আসছেন। এই সময়ে বিভিন্ন দেশ নিজেরা এবং সেই দেশের কোম্পানিগুলিকে ইভি এবং ক্লিন এনার্জি-এ রূপান্তরিত করার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে। এতবড় কর্মকান্ডের যারা অর্ফিয়ুস, সেই কঙ্গোর কিশোর ও যুব শ্রমিকরা পৃথিবী থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ খনিজটি মুছে ফেলার জন্য বিনিময়ে কিছুই প্রায় পাচ্ছে না। ইভি নিয়ে রোমান্টিসিজম প্রসূত পরিবেশ-জীবন-জীবিকার সংকটে, কঙ্গোর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী একটি বড় মূল্য চোকাতে পারে। পৃথিবীর বায়ুদূষণ কমিয়ে(তথাকথিত) অসুরক্ষিত ভবিষ্যৎ ও ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে একদিন তারা তাদেরই দেশের দায়ে পরিণত হবে।

KCC, Glencore নামের একটি বহুজাতিক সংস্থা দ্বারা পরিচালিত খ্যাতনামা খনিজ কোম্পানি। কঙ্গোর কপার বেল্টের প্রায় কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। প্রতি বছর মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি র ব্যাটারির জন্য বিশ হাজার টন কোবাল্ট এরা জোগান দেয়। KCC নাকি সুশাসিত। বেশ কিছু সমীক্ষা কিন্তু বলছে সেখানে মজুরি এবং কাজের পরিস্থিতি আদর্শের কাছেপিঠেও নেই, প্রাণহানির ঘটনাও লেগেই থাকে। KCCর ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত শ্রমিকেরা বলেন সপ্তাহে পাঁচ দিন বারো ঘণ্টার শিফটে কাজ করার সময়, তাঁদের দুপুরের খাবারের বিরতি প্রায় থাকেই না। পদোন্নতির সময় কঙ্গোর মানুষদের তুলনায় বিদেশিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। Glencore এ সবই অস্বীকার করে। মূল ক্রেতা টেসলার বক্তব্য জানা যায় না, কারণ বছর তিনেক তাঁরা কঙ্গোর খনিজ উৎপাদন সংক্রান্ত প্রশ্নের আর কোন উত্তর দেন না।

সর্বত্রই শ্রমিকদের পদোন্নতির পথ কঠিন। বেঞ্জামিন সোভাকুল (সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়) কোবাল্ট খনি নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেছেন, কোম্পানিগুলির কঙ্গোতে পরিচালনায় ঘৃণ্যতম কিছু অভ্যাস বিদ্যমান। সুপারভাইজারের মারধর, লাথি, বেত্রাঘাত এবং অপমান চলতেই থাকে।

অসম্মান বা শোষণের সঙ্গে কঙ্গোর পরিচয় কম করেও সোয়া শ’ বছর। বেলজিয়ামের রাজা, দ্বিতীয় লিওপল্ডের জেনোসাইড আমরা ভুলিনি। ভুলিনি তার কিছুদিন পরেই বেলজিয়ান শিল্পী অ্যার্জের স্কেচে ‘কঙ্গোয় টিনটিন’ বইয়ের পাতায় পাতায় কঙ্গো-বাসীদের নিয়ে নিষ্ঠুর রসিকতাও।

আজ সাম্যবাদের ধ্বজাধারী চীন, কঙ্গোর কোবাল্ট খনিগুলির উপর একাধিপত্য কায়েম করেছে। ইভি ব্যাটারি উৎপাদনে চীনের সংস্থাগুলি ইউরোপ বা আমেরিকাকে হারিয়ে দিয়েছে, প্রথম পাঁচে তাদের দেশেরই দু’টি কোম্পানি। শ্রমিক শোষণ নিয়ে চীনের বিশ্বজুড়েই নিন্দিত, সেই ট্র্যাডিশন কঙ্গোতেও চলারই কথা। কোবাল্টের চাহিদা বৃদ্ধিতে কঙ্গোর খনি শ্রমিকদের দুর্দশা বাড়বে, যদি না দেশটির শ্রমনীতি সঠিক হয়। দেশটির সরকার শেষ পর্যন্ত যদি পদক্ষেপ নেয়, তবেই ভাল কিছু আশা করা যেতে পারে।

নাম্বার ওয়ান, তাই বিপন্ন তাইওয়ান

উৎপাদনের পর গাড়ি কেমন চলবে, ব্রেক কত ভাল হবে, ব্যাটারি কতদূর চার্জ ধরে রাখবে ও তার আয়ুষ্কাল কত হবে – এই সবই নির্ভর করে সেমি-কন্ডাক্টরের ওপর। মজার কথা হল, চীন ধাতুগুলি জোগাড়ের ব্যবস্থা করেছে কিন্তু সেমি-কন্ডাক্টর নির্মাণে খুব আহামরি সাফল্য পায়নি। এই প্রযুক্তি আয়ত্ত করতে আমেরিকা, আরব দুনিয়া প্রভৃতি সকলেই মুঠো মুঠো টাকা উড়িয়েও পারেনি। সেমি-কন্ডাক্টরের আঁতুরঘর তাইওয়ান, মেধায় বলীয়ান দেশটি পৃথিবীর প্রায় ষাট শতাংশ সেমি-কন্ডাক্টর তৈরি করে। প্রতিযোগিতায় তাইওয়ানের আশেপাশে অন্য কোন দেশ নেই। শুরুতে যা বলছিলাম, মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী। সেমি-কন্ডাক্টর নিয়ে চীন একটি সহজ সমাধান পেয়েছে, তা হল বন্দুকের নলের মাধ্যমে তাইওয়ানের ক্ষমতা অধিকার করা ও বিশ্বের সেমি-কন্ডাক্টর উৎপাদনেও মনোপলি কায়েম করা। বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির জন্য প্রথম যুদ্ধটি হলে সেই দেশে অসংখ্য প্রাণহানি হবে। যুদ্ধের প্রভাবে আরও কিছু দেশ দেউলিয়া হবে, সারা বিশ্বে সেজন্য কত প্রাণ যাবে কেউ জানে না।

“প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা”

বৈদ্যুতিক যান গ্রহের জন্য ভাল, এমন চিন্তার বিপক্ষে কিছু প্রশ্ন উঠে আসে।

  • আমরা কি ভবিষ্যতের দায় না নিয়ে খালি বৈদ্যুতিক যানের লাভটুকুই নেব এমন অবস্থান নিচ্ছি?
  • এই ক্রেতারা, যারা বেশি দাম দিয়েও ইভির প্রতি আকৃষ্ট তারা কি জানেন ব্যাটারির কাঁচামালের উৎস?
  • বায়ুদূষণ কমাতে দাসপ্রথা, শোষণ বা সাম্রাজ্যবাদের মধ্যযুগীয় পথ সমর্থনযোগ্য? তার জন্যে কি পৃথিবীর কোন দায় নেই?
  • Go Green নামে স্লোগানটি লিখতে এত লাল রং ব্যবহার হওয়ার পর কী আদৌ তা কোনদিন সবুজ হবে ? 

উপসংহার

স্বাভাবিকভাবেই এবার প্রশ্ন আসে, কমপক্ষে সাড়ে তিনশো ওয়াট বিদ্যুৎ খরচ করে ও লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার করে এতক্ষণ এই ব্যাটারির বিরুদ্ধে কেন কথা বলছি। মনে হতে পারে, কোন কোন জায়গায় প্রায় তৈলচালিত চিরাচরিত গাড়ির সঙ্গেই যেন তুলনা করে কোথাও ওকালতি করা হল।

এমন উদ্দেশ্য প্রতিবেদকের অবশ্যই নেই। পরিবেশের ন্যূনতম ক্ষতি করে মানব সভ্যতার বিকাশের চাবিকাঠি সম্ভবত উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থার বিকাশেই লুকিয়ে আছে। আজকাল চার/পাঁচ কিলোমিটার তো দূরস্থান আমরা এক কিলোমিটার যেতেও সাইকেল ভুলে মোটরবাইক ব্যবহার করছি। যে ব্যাপারে ত্যাগ স্বীকার করতে কিন্তু বিশ্বজুড়েই প্রায় মানুষের সদিচ্ছার অভাব প্রকট।

আরও পড়তে পারেন – ‌তপনদিঘিতে সরকারি স্বৈরতন্ত্র