‌তপনদিঘিতে সরকারি স্বৈরতন্ত্র

কেন্দ্রীয় জল সম্পদ দপ্তরের আধিকারিকদের দল গতকাল পৌঁছেছিলেন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার তপন ব্লকের, তপন দিঘির সংস্কারের কাজ পরিদর্শনে। গ্রাম বাসীদের সামনে তারা উষ্মা প্রকাশ করলেন সংস্কারের কাজে লম্বা পাঁচিল কেন ? ক্যাচমেন্ট এলাকার জল দীঘিতে এসে পৌঁছাবে কি করে ? আদিবাসী গ্রামের কৃষকের চাষের জল কি ব্যবস্থা হবে ? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানা নেই।

(এক)

দেশ-বিদেশে খ্যাতি সম্পন‌্ন জলাশয় ও নদী বিশেষজ্ঞ রাজেন্দ্র সিং বালুরঘাটে আত্রেয়ী নদী পর্যবেক্ষণে এসে ছিলেন ২০১৯ সালের আগষ্ট মাস নাগাদ। তাঁর মূলতঃ একদিনের কর্মসূচীর মধ্যেই “তপন দিঘি ও পরিবেশ সুরক্ষা সমিতির” অনুরোধে প্রবল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও তপন দিঘির পাড়ে একবার আসেন। দিঘির দক্ষিণ পাড়ের ‌ফাঁকা জায়গা খুঁজে দিঘিকে‌ দেখার চেষ্টায় স্বাভাবিক ভাবে তার চোখে পড়ে পর্যটন দপ্তরের কিছু নির্মান কাজ ও সেটাকে ঘিরে রাখা বাহারি প্রাচীর। তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল-“এখনই (সাধারন মানুষ এর দ্বারা) সব কংক্রিট নির্মান গুলি ভাঙা শুরু হোক। কোন প্রাকৃতিক জলাশয়কে এভাবে কংক্রিট ঘিরতে পারে না।” আসলে ২০১৪-১৫ সালে রাজ্যপর্যটন দপ্তর ৭০লক্ষ টাকার এক প্রাথমিক অন‌ুমোদনে কাজ শুরু করেছিল। কটেজ, শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য কংক্রিটের গুহ‌া, সোলার বাতিস্তম্ভ সবই হয়েছিল। তবে ঘেরাটোপে কখনও পর্যটকের আশ্রয় হয়নি। যদিও আশেপাশের ও দূর থেকেও তপনদিঘি দেখতে যাওয়ার মানুষের এক প্রবনতা আছে, আর ঐতিহাসিক বানগড়ের ধ্বংসস্তুপ। সেদিন রাজেন্দ্র সিং-এর কথায় সাড়া দেবার কেউ ছিল না। তপনবাসীদের একদল ভাবছিল যে পর্যটন কেন্দ্র হলে রুজি-রোজগারের সুবিধা হবে, আর একদল ভেবেছিল, ওখান থেকে একটু দূরেই পুলিশ থানা, সরকারি দপ্তরের নির্দেশে তারা তো ঝাঁপিয়ে পড়বে, তার মোকাবিলা করা কী সাধারন মানুষের পক্ষে সম্ভব! তবুও মজে যাওয়া তপন দিঘির দিকে বহু মানুষেরই অতীত ছবির ঢেঁকুর উঠেছিল, কারো কারো বুকে মোচর ও দিচ্ছিল। ঠিক এখন, ২০২১-এর অগাষ্টে, রাজেন্দ্র সিং এলে কী বলতেন, সে প্রেক্ষাপট গুলোতে ক্রমশঃ আসা যায়। এখন পর্যটন দপ্তরের ন‌ির্মানগুলোর ভগ্না- বশেষ মাটিতে সেঁধিয়ে আছে নতুন চলা নির্মান কাজের নীচে। কোল্ডস্টোরেজের ঘর সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। প্রশাসনিক ভবনের (আরো কিছু হয়ত‌ঃ) পিলার ও ভিত পুরো দক্ষিন দিকটায় পুরোপুরি অনুচ্চ প্রাচীরে ঘিরে রেখেছে। অর্থাৎ প্রাচীরে দুটো স্তর। পুরো ঘর বাড়ি গুলো হয়ে গেলে, দ্বিতীয় স্তরটা আকাশচুম্বী হবে। সমস্ত জলভাগের সমস্ত জলভাগের সীমানা ঘেঁষে আর একটা প্রাচীর, জল ঘেরাও করার প্রাচীর। আপাততঃ গাঁথনি হয়েছে। পাড়ের থেকে ফুট চারেক উঁচু। পিলারগুলো বলছে আরো অনেক উঁচূ হবে। অর্থাৎ বাইরে থেকে জলাশয় আর দেখা যাবে না। এখনও জলাশয়কে যতটুকু দেখা যায়। তাতো আর জলাশয় না। সবুজ দলে ভরা এক বিরাট মাঠ। অনেক নীচু ভূমি। ২০২০সালে দিঘির জল লকগেট খুলে নয়ান জুলি দিয়ে খাঁড়িতে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ তপনদিঘি আর নেই। দিঘির সেই অবস্থানটার অস্তিস্থটা এখনও আছে। আর আছে জমি।

তপনদিঘি
তপনদিঘি
(দুই)

কিন্তু তপনদিঘি কে এখনও বাঁচানো যায়, মুমূর্ষূ রোগীকে ভেন্টিলেশনে কিছুটা সময় রেখে তারপর যেভাবে বের করে আনা যায়, সেই পদ্ধতিতেই। যদিও সময় নষ্ট হওয়া মানে রোগীকে বাঁচাবার সম্ভাবনা কমিয়ে দেওয়া। একটা বর্ষা পার হয়ে গেল, অর্থাৎ আরো কিছুটা সময় নষ্ট হল। দিঘিতে আশে পাশের সমস্ত বর্ষাধোয়া জল প্রবেশ করানো খুব প্রয়োজন ছিল। শীতে দল বা জলজ জঙ্গল সাফ করা। আমাদের রাজ্যের জনমোহিনী মূখ্যমন্ত্রী ২০১৯ সালে স্থানীয় এক জনসভায় এসে দিঘির মজে যাবার খবরটা পান। তিনি ৩৭কোটি টাকা দিঘি সংস্কারের জন্য প্রাথমিক ভাবে ব্যয় বরাদ্ধ করেন। তারপর জল শুধু শুকিয়েছে ব্লটিং পেপারের মত কে কি শুষছে তার একটা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এবং এলাকার স্বার্থ বিনষ্টকারী মানুষদের শাস্তি দেওয়ারও প্রয়োজন। সে কথা পরে ভাবা যাবে। দিঘির সংস্কার প্রক্রিয়ার কথায় ফেরা যাক। সম্ভবত এখন তা সুনির্দিষ্ট দপ্তরের উপরে ভার দেওয়া‌ হয়েছে।

এসেছে মাছের ভেড়ি এলাকার সংস্কারের বড় ঠিকাদার সংস্থা, দাদা শুভেন্দু অধিকারির মান রাখতে(তাদের কথাতেই) কাজের নমুনা প্রথম পর্বে কিছু উল্লেখ করা হয়েছে। তপনে গত দু-বছর ধরে বিভিন্ন স্তরে ক্ষোভ বাসা বাঁধছে। গত বিধানসভা নির্বাচন ও তার বছরখানেক প্রস্তুতি পর্ব থেকে ক্ষোভ ব্যবহার করার তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কার পেছনে থাকলে বেশী লাভ‌ হবে সেই প্রশ্নে “তপন দিঘিও পরিবেশ সুরক্ষা সমিতি” তেও ধরেছে ক্ষয় রোগ। বালুরঘাটের সংসদ সুকান্ত মজুমদার আশ্বাস দিয়েছিলেন ইস্যু টা নিয়ে কোর্ট -কাছারি করবেন। এতে উৎফুল্ল কেউ কেউ তার পিছনে ভিড় করেছে। পরবর্তী কালে তিনি আর কোন তথ্য হাজির করতে পারেননি (হাজার হোক দাদা তো এখন তারও)। তবে আমাদের এখন অনুসন্ধান করতে হবে যে, তপন দিঘি কে নিয়ে এত মাথাব্যথার কোন দরকার আছে কি না ? কত জলাশয় কত পুকুর দিব্যি হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। মানুষের নাকি–কতিপয়ের আরোও উন্নতি ও ভালো থাকার জন্য।

(তিন)

গবেষনা চর্চার ইতিহাস আলোচনায় তপনদিঘি কে নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়নি। শুধু তপনদিঘি কেন, উত্তরবঙ্গ ভৌগলিক অবস্থানটায় যে উন্নত মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, পালযুগ, সেনযুগ ও গৌড়-মালদহের কথা কিছু কিছু সময়ে কিছুটা আলোকপাত হয়েছে এটা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারিদের চিন্তার রেশ। তিনশো বছরের কলকাতা থেকেই সব কিছুই নির্ধারন ও অনুমোদন হয়। অথচ বাংলাদেশে প্রত্যেক জেলায় আলাদা স্বত্বাধি-কারিদের পরিচালিত স্বয়ং সম্পূর্ণ সংবাদপত্র আছে। এটা শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীভবনের উজ্জ্বল উদাহরণ। যাইহোক আমরা তপনদিঘি র কথায় আসি যতটুকু উল্লেখ বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায় তাতে স্বাধীন ভারতও বাদ দিলাম। ব্রিটিশ শাষন থেকে কোন ঐতিহাসিক রাজা, সম্রাট সুলতানের দাবি পাওয়া যাচ্ছে না যে, তাদের নিয়ন্ত্রণে তপন দিঘি সৃষ্টি হয়েছিল দুটো সময় এর গেজেটিয়ার অনুযায়ী দুটো লোক কথার ঊল্লেখ পাওয়া যায়। (১)-রামায়ণ প্রনেতা বাল্মিকী স্বয়ং এই দিঘিতে স্নান সেরে এর পাড়ে তর্পণে বসেছিল। (২)-বানগড়ের রাজা এই দিঘিতে স্নান-তর্পণ করতেন। এই দুটি লোককথা অনুযায়ী এই দিঘির নাম তর্পণ দিঘি। ক্রমশঃ তর্পণ কথাটি তপন হয়ে যায়।

আমরা ইতিহাসের আর একটা অংশে যদি চোখ রাখি, (যদিও সে ইতিহাস রচনা সম্পূর্ণ নয় বলা উচিত)। তা হল একাধিক নদীর নিজেদের পরিক্রমার ইতিহাস। ১৭৮৭ সাল এর আগে অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী ছিল উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী। তিস্তা প্রবাহে-র মূল খাত। আরো উল্লেখ আছে যে আত্রেয়ী ও যমুনা বিভিন্ন সময়ে মূল প্রবাহ এর পথে ছিল। আবার দেখা যাচ্ছে কোশি বা কৌশিকি বর্তমান উত্তর দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে করোতোয়ার সাথে মিলিত হয়েছিল। তাদের সম্মিলিত বয়ে আনা পলিমাটি ও বালু নিম্নবঙ্গের জলাভূমিকে সমতল করেছিল। উল্লেখে পাওয়া যাচ্ছে যে ১৮শতক পর্যন্ত গঙ্গাও ব্রহ্মপুত্রের দূরত্ব ছিল ১৫০ মাইল। স্বাভাবিক ভাবে মাঝ দিয়ে সমুদ্র অবধি ছিল এই নদী, ১২০৫ সালে বক্তিয়ার খিলজির তিব্বত অভিযানের বর্ননায় বলা হয়েছে এই সম্মিলিত নদী গঙ্গা থেকেও তিন গুন চওড়া ভ্যান-ডেন-ব্রুকের নদী মানচিত্র(১৬৬০) সাল অবধি গঙ্গার পূর্বমুখী যাত্রায় তা করোতোয়ার প্রবাহের সঙ্গেতা মিলেমিশে যায়। ওদিকে বারিন্দ্র অঞ্চলে পলিরদ্বারা সৃষ্ট শক্ত মাটির স্তর করোতোয়াও কৌশিকি উভয় নদীর প্রবাহকে বাধাপ্রাপ্ত করে, ফলে সম্মিলিত নদীর ধারা দুধারে সরে যায়। উপযুক্ত চর্চা হলে, এই নদী সরে যাবার প্রক্রিয়ায় তপন সহ অঞ্চলের বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাশয় গুলি সৃষ্টির কারণ জানা যাবে তপন ও সম্মিলিত এলাকা ঐ শক্ত ও উঁচু পলিমাটির স্তরের ওপর গড়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবে বর্ষাকাল ছাড়া খরা প্রবন। আর প্রাকৃতিক জলাশয় গুলো মাটি ও জলের গ্রন্থি হিসেব কাজ করে। তথাকথিত উন্নয়নের মুনাফা ও দালালি এলাকা ও এলাকাবাসীর লাভ-ক্ষতির হিসেব করে না।

(চার) 

করতোয়া ও কৌশিকির সম্মিলিত ধারায় যে কোনো কারণ বশতঃ একসাথে অনেকটা পলিমাটি চলে আসে ও তা ঢিবি হয়ে নদীর মুখে জমে যায়, যাতে নদী দুপাশে সরে যেতে বাধ্য হয়। এটা কোন স‌ময়কালে বা কৌশিকি হয়ে সে পলিমাটি বয়ে এনেছিল কিনা তার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ কোথাও নেই। প্রক্রিয়াটা পরবর্তী কালে প্রত্যক্ষ করা গেছে করোতোয়া থেকে মূল প্রবাহ বর্তমান তিস্তায় চলে যাবার সময়, সে সময় রেনাল নদীর মানচিত্র তৈরি করতে ঘোরাঘুরি করছেন আর ইংরেজ দখলদাররা সমস্ত ভৌগলিক পরিস্থিতির উপর পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে উত্তর-দক্ষিণ দিনাজপুরে অসংখ্য জলাশয়ের অস্তিত্ব রক্ষনা-বেক্ষনের অভাব ও অপব্যবহারে, তথা সরকারি আর্থিক দুর্নিতিতে নষ্ট হলেও এখন দেখা যায়। সুদূর অতীতে এটা মৎস্য দেশ বলে পরিচিত ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিকদের ধারণা। এই এলাকার মূখ্য দেবী ছিলেন মৎস্যকন্যা। এখন থেকে বিশ পঁচিশ বছর আগেও এখানে প্রচুর পরিমানে মাছ পাওয়া যেত। ১৯৭১সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের আগে মৎস্যজীবি বলে পেশাগত সম্প্রদায়ের অস্থিত্ব ছিল। আজ এই করোনা কালে, যখন উৎপাদন ও ব্যবসার সুযোগ প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে আর সরকারি রক্ষণা-বেক্ষণ ও দুর্নীতি-র জন্য আমরা অমূল্য একটা ক্ষেত্রকে হারিয়েছি। তবে পুরনো অবস্থায় ফিরতে সুদূর প্রসারি পরিকল্পনা নিতে হবে। এবার খরা প্রবণতা নিয়ে কিছু কথায় আসা যাক। পলিমাটির উঁচু ঢিবির জন্য যে নতুন ভৌগলিক গঠনের এলাকা সৃষ্টি হয় তপন দীঘি সংলগ্ন এলাকা ও তার উত্তর দিকের প্রান্তে। এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল বারিন্দ্র অঞ্চল, যা অবিভক্ত বাংলার কয়েক জেলায় ছড়ানো। এখানকার জমির উর্বরতা যথেষ্ট উঁচু মানের হলে পুরনো নদী খাতের জলের স্তর অনেকটাই নীচে। ফলে বর্ষার জল নির্ভর ছিল এখানকার চাষাবাদ। ১৯০৫ সালের গেজেটিয়ার অনুযায়ী ইংরেজ আগমন এর প্রথম অবস্থাতেও তপন সংলগ্ন অঞ্চল থেকে বানগড় পর্যন্ত ঘন স্বাভাবিক শাল জঙ্গল ছিল। ইংরেজরা কৃষি রাজস্ব বাড়ানোর প্রয়োজনে প্রথমে তার নিধন কর্মসূচী নেয়। কালক্রমে দেশভাগ, শরনার্থীদের আগমন, তাকে ঘিরে প্রব্রজন ইত্যাদিতে আজ কোনো জঙ্গলের অস্তিত্বই নেই। কৃষি ও মাটির নীচের জলস্তর বোঝার জন্য এই আলোচনা প্রয়োজন। তপন বাজারে দশ/পনের বছর আগে শুদ্ধ পানীয় জলের জন্য একশ ফুটের কিছুটা বেশী যে গভীর নলকূপ বসানো হয়েছিল এখন সেই জলের রং লাল। ফলে দেড়শ ফুটের বেশী গভীর নলকূপ থেকে এলাকার পানীয় জল সরবরাহ হচ্ছে। কোনো কোনো জমিতে চাষাবাদের প্রয়োজনে ৩০০ ফুটের বেশি গভীর নলকূপ বসাতে হচ্ছে। বলা হয় যে, মাটির গভীরের জলে আর্সেনিক প্রভাবের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তপন দিঘি বাঁচানোর সংগ্রাম হওয়া উচিত, এ-সব কিছু কে মাথায় রেখেই।

(পাঁচ)

এই কিস্তির নাম যদি একটু পাল্টে দেওয়া যেত”আদিবাসী দের জীবনের পরিবর্তে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের উন্নয়ন কর্মসূচীর একটা দৃষ্টান্ত। যতটা জানি সম্ভবত ‘নিয়ম গিরি’তে তীব্র প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে কোটি-কোটিপতি ও রাজনৈতিক নেতা তথা সরকারের কর্মসূচী বাজে কাগজে পরিনত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন ভারতে প্রায় ৯০% উন্নয়ন,আদিবাসী দের জমি, জীবিকা, জীবনের পরিবর্তে হয়েছে। সেখানে মোটা মাইনে পাওয়া নাগরিকদের তাদের সর্ম্পকে কোন সহানুভূতি বা সহযোগিতার মনোভাব নেই। সংবিধান এই রোগকে চিহ্নিত করেছে কিন্তু দূর্বলভাবে। তাই ৭৫ বছর পার হয়েও একই দশা। যাই হোক এই বির্তক হচ্ছে, হবেও । তপনদিঘি র সংস্কার তথা উন্নয়ন কর্ম-সূচীতে২০১৯ থেকে দিঘি পার্শ্বস্থ কাজি ভাগ ও দ্বিনগর গ্রামে কৃষিজমিতে জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এটি দিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে আদিবাসী অধ্যূষিত একটি গ্রাম। এখন তারা শুধু বর্ষার জলের উপর নির্ভর করে চাষ করে অথচ ১৯৮২ সালে রাজ্যপাল ভৈরব পান্ডে একটি আধুনিক সেচ ব্যবস্থার উদ্বোধন করে গিয়েছিলেন। আমলাতান্ত্রিক গড়ি-মসিতে তা বৈপুতায়ন হয় ২০১২ সালে। বৃষ্টির জলে পুষ্ট জলাশয় এর জল নির্ভর চাষাবাদ করে আর সার ব্যবহার না করে গ্রাম দুটির কৃষক পুরষ্কৃত ও প্রশংসিত হল। আর তপন দিঘির উন্নয়নের প্রথম বলি হল তারাই। অনুসন্ধানে যা পেয়েছি,উত্তরে সালাশ মৌজা ওপূর্বে কসবা মৌজাতেও চাষের জল সেচ ব্যবস্থা ব্যাতিরেকে নয়ানজুলি দিয়ে দিঘির জল পৌঁছে যেত তাদের প্রাথমিক প্রয়োজনে। প্রসঙ্গতঃ বলা যায়,আগেই উল্লেখ হয়েছে, এই পলি মাটিতে গড়া জমির উর্বরতার মান অতি উৎকৃষ্ট; অবিভক্ত বাংলায় দিনাজপুর কে “শস্যভান্ডার” বলা হত। বিভক্ত পশ্চিমবঙ্গে অনন্ত দেড়-দশক পশ্চিম দিনাজপুর ঐ নামে খ্যাত ছিল। কিন্তূ উত্তরবঙ্গের প্রতি বঞ্চনায় এলাকাটা পিছিয়ে যেতে থাকে। সরকারী বদান্যতায় ও প্রভাবশালী লোকের লোভে তপনদিঘি র হাল কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছিল তার একটা হিসেব নেওয়া যেতে পারে। জেলা গেজেটিয়ার অনুযায়ী ১৯৩৪-৪০এ জল ধারনের এলাকা ছিল ১১৭.৩৫ একর। বর্তমান সরকারি রেকর্ডে ৮০-৮৫একর। ১৯৪২ সালে ও ১৯৮৪সালের মানচিত্রের বিশেষ কোন পরিবর্তন নেই। অথচ মৎস্য দপ্তর সহ অনেক কিছুই তখন ছিলনা। যা এখন সে জায়গা গুলোতে দেখানো হচ্ছে। অর্থাৎ একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে কারচুপি। নতুন প্রকল্প শুরু হবার পর ৭.২ একর জলভাগ জমি সরকারি ভাবে দেওয়া হয়েছে দশ জনের নামে। যার মধ্যে একজন জমি নিবন্ধিকরন  অফিসের মহুরী,আর নয়জন শাসক দলের সম্পর্কিত। কিসসা বাড়ানো যায়। কিন্তু এখানে চক্রান্তের মধ্যে আদিবাসিদের কৃষিকাজের জল বন্ধ করে দেওয়া মুখ্য আলোচনা, আর তপন দিঘি শেষ করা মানে ভবিষৎ এ এক ঊষর প্রান্তর সৃষ্টি করা।       

‘বিজ্ঞান বার্তা’য় পূর্ব প্রকাশিত পরিবেশ-রাজনৈতিক কর্মী রূপক মুখার্জীর লেখা পুন:প্রকাশিত দি ডিগ্রোথের পাতায়।

আরও প্রতিবেদন পড়তে ক্লিক করুন – আন্দোলনের জলে পাঙ্গাস রুই কাতলা সিলিন্দী